সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ব্যবসায়ী সমাজ গ্রাহকদের চাহিদা মতো পণ্য ও সেবা তাদের হাতের নাগালের মধ্যে পৌঁছে দিয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বড় সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে । তার বাইরেও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেও সমাজকে সেবা দিচ্ছে। কিন্তু এই স্বাভাবিক কর্তব্য- কর্মের বাইরেও তাদের সমাজের জন্য অনেক কিছু করার রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন । এজন্যই বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মানুষের মরণঘাতি অসুখের চিকিৎসার গবেষণায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে । হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, হাসপাতালে বিভাগ চালু, চিকিৎসা সেবা প্রদান, পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অবহেলিত মানুষকে সহায়তা দান, স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি, পরিবেশ সুরক্ষা ইত্যাদি কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে । IBM এর কর্ণধার বিল গেটস, গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানান ভাবে শত শত কোটি ডলার সহযোগিতা করছেন। ভারতে টাটা, বিড়লা ইত্যাদি বড় বড় কোম্পানি হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে সেবা দিচ্ছে । বাংলাদেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালন (CSR) এর বিষয়ে এগিয়ে আসছে । নিম্নে তার কতিপয় উল্লেখ করা হলো:
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি সরবরাহ, খেলাধুলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারী উন্নয়ন, প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়ন, বিধবা নারীদের ভাতা প্রদান, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদ পরিবারের জন্য কল্যাণ ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ দেশের ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে । CSR এর আওতায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো যখন ৫৫ কোটি টাকা খরচ করেছে তখন ২০১২ সালে এ কার্যক্রমে ব্যয়িত হয়েছে ৩০৪.৬৭ কোটি টাকা ।* এ সময়ে শুধুমাত্র শিক্ষাখাতে ব্যয় হয়েছে ৯৮.৩৮ কোটি টাকা ।
২০১২ সালে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক CSR এর পিছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তার চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ব্যাংকের নাম | CSR এর পিছনে ২০১২ সালে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ |
১. ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড | ৫২.৭৭ কোটি টাকা |
২. এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড | ৩৯.১০ কোটি টাকা |
৩. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড | ৩০.১১ কোটি টাকা |
৪. প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড | ২৯.৫৭ কোটি টাকা |
৫. জনতা ব্যাংক লিমিটেড | ১৩.৭৬ কোটি টাকা |
৬. ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড | ১৩.০২ কোটি টাকা |
৭. অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড | ১০.৪১ কোটি টাকা |
৮. ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক লিমিটেড | ৯.৪৪ কোটি টাকা |
৯. মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড | ৮.৫ কোটি টাকা |
১০. শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড | ৭.৯২ কোটি টাকা |
বাংলাদেশে ব্যাংকসমূহের মধ্যে ডাচ বাংলা ব্যাংক CSR এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে । তারা ২০১১ সালে ৬,০৩৫ জন শিক্ষার্থীকে ১৬ কোটি টাকা প্রদান করেছে। ব্যাংকটি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে একটা ক্যাথ ল্যাব (Cath Lab) এবং লিভার ও কিডনি সংযোজনের জন্য দু'টি অপারেশন থিয়েটারের পিছনে ৯.৩৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে । ২০০৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ৩,০০০ এর বেশি ঠোঁট কাটা রোগীর প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থা করেছে । বিভিন্ন সময়ে ৩৫১ জন এসিড দগ্ধ নারীকে ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করেছে। ৮০০ এর বেশি বিধবা মহিলাকে ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করেছে। ২০০৭ সালের সিডর দুর্গত মানুষের জন্য ব্যাংকটি ৪.২২ কোটি টাকা প্রদান করে । এ ছাড়া ব্যাংকটি পরিবেশ সুরক্ষায় ও ভোটার আইডি কার্ড তৈরি সহ বিভিন্ন খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে ।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণ ফোন CSR এর আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে সমাজের মানুষদের জন্য কাজ করে চলেছে। জন সচেতনতা সৃষ্টি, সরকারের টীকাদান কর্মসূচিতে সহায়তা দান, চক্ষু চিকিৎসা সেবা প্রদান, টেলি চর্ম চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, নিরাপদ মাতৃত্ব ও শিশু যত্ন সেবা প্রদান, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ সেবা, অনলাইন স্কুল সেবা, শিক্ষা বৃত্তি, খেলাধুলায় সহায়তা দান, নন ফরমাল প্রাথমিক স্কুল কাম ঘুর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সমাজ সেবামূলক কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি CSR এর ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথে মিলে শিশুদের পোলিও খাওয়ানো ও টীকাদান কর্মসূচিতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৪টি চক্ষু শিবির (Eye camp) করে ৩৬,৩২৭ জনকে ফ্রি চিকিৎসা এবং ৪,৭৪৩ জনকে ফ্রি সানি অপারেশনে সহযোগিতা করেছে। গ্রামের চর্মরোগীদের টেলি চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানটির আরেকটি জনসেবা কার্যক্রম । ২০১২ সালে ১,৫০০ এর বেশি রোগী এ পদ্ধতিতে বিজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা লাভ করেছেন। পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল এর সাথে সহযোগিতায় ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ‘সুর্যের হাসি’ প্রজেক্ট এর আওতায় ১৭,০৩,৭৬৭ জন মাকে নিরাপদ মাতৃত্ব সেবা সহযোগিতা প্রদান করেছে ।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য উদ্যোক্তা মরহুম আকিজ উদ্দিন প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ বাংলাদেশের একটা অন্যতম শিল্প গ্রুপ হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০টির মত সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘আকিজ’ সহ বিভিন্ন নামে কর্মরত রয়েছে। বাংলাদেশে CSR এর ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত সুবিদিত। তাদের প্রতিষ্ঠিত আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশন চিকিৎসা সেবা প্রদানে অনন্য নজীর সৃষ্টি করেছে । এই ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নরূপ ;
আদ-দ্বীন ফাউন্ডেশনের বাইরেও প্রতিষ্ঠানটি আকিজ ফাউন্ডেশন স্কুল, আকিজ এতিমখানা, শেখ আকিজ উদ্দিন হাইস্কুল, ফিরোজা ফাউন্ডশেন নামে কতকগুলো শিক্ষামূলক ও সমাজধর্মী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য গ্রুপের অধীন শেখ আকিজ ফুটওয়্যার (SAF) লিমিটেড ঢাকায় টেলিফোন কলের মাধ্যমে খুবই কম খরচে এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস পরিচালনা করছে । এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সাপ্তাহিক দু'টি দাতব্য শিশু সেবা কেন্দ্র পরিচালনা করে । ঢাকায় প্রতিবছর তারা বড় ধরনের চক্ষু ক্যাম্প পরিচালনা করে থাকে। যেখানে কমবেশি দু'হাজার রোগীকে তারা স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৩৬টি চক্ষু ক্যাম্প পরিচালনা করেছে । যেখানে ৪৩,৬৫৯ জনকে চক্ষু স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং ৩,৩১৬ জনকে ছানি (Cataract) অপারেশন করানো হয়েছে । এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, পলিও ক্যাম্পে সরকারের সাথে কার্যক্রম পরিচালনা, বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিশোধন এবং বৃক্ষ রোপনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি পালন করছে । একইভাবে আকিজ গ্রুপের অন্যান্য প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেরও এরূপ নিজস্ব CSR কর্মসূচি রয়েছে ।
প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত স্কয়ার গ্রুপ বাংলাদেশে একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প গ্রুপ হিসেবে পরিচিত । প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালন (CSR) এর বিষয়ে যত্নশীল । গ্রাহকদের উত্তম মানের পণ্য সরবরাহের পাশাপশি কর্মীদের কল্যাণের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত আন্তরিক । শ্রমিকদের যে সকল অধিকার আইনে বলা হয়েছে তার অনুসরণে প্রতিষ্ঠানটি সচেষ্ট । সরকারকে রাজস্ব প্রদানে প্রতিষ্ঠানটি স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়ে থাকে । যে কোনো ধরনের দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি 0 (Zero) Tollerence এর নীতি অনুসরণ করে । প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় একটা বড় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সচেষ্ট রয়েছে । স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন NGO প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এছাড়া দেশে খেলাধুলার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। পাবনায় প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানসহ অন্যদের পড়াশুনার জন্য ভালোমানের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুনাফাবিহীনভাবে পরিচালনা করছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানটি এর নারী শ্রমিক-কর্মীদের আবাসন সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে থাকে`। তথ্য প্রযুক্তির বিষয়ে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা, পাবনার ঐতিহ্যবাহী আনন্দ গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি পুনঃনির্মাণ ও উন্নয়ন ইত্যাদি জনহিতকর কাজে প্রতিষ্ঠানটির উজ্জ্বল ভূমিকা ভবিষ্যতেও বহাল থাকবে বলে আশা করা যায় ।
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত গেটস ফাউন্ডেশন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও স্বচ্ছতার সাথে পরিচালিত প্রাইভেট ফাউন্ডেশন । মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি জগতের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্দা গেটস এর নামে ফাউন্ডেশনটি গঠিত। এই ফাউন্ডেশনের তিনজন ট্রাস্টি হলেন মি. ও মিসেস গেটস এবং প্রখ্যাত শেয়ার ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেট (Warren Buffet) । ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের হিসাব মতে ফাউন্ডেশনের দানপ্রাপ্ত সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৩৬.২ কোটি বিলিয়ন ডলার । প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি তার সম্পদের কমপক্ষে ৫% মানব কল্যাণে দান করে থাকে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৪.৪ বিলিয়ন ডলার দান করেছে। যার বাংলাদেশী টাকায় মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩৬,০০০ কোটি টাকা । প্রতিষ্ঠানটির দানের তিনটি প্রধান খাত হলো-
১. বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি (Global Health Program) : এই কর্মসূচির আওতায় প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অর্থ সহযোগিতা প্রদান করে । এক্ষত্রে উল্লেখযোগ্য কতিপয় খাত নিম্নে তুলে ধরা হলো-
২. বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি (Global Development Program) : বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ফাউন্ডেশন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
৩. যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কর্মসূচি (United States Program) : গেটস ফাউন্ডেশন আমেরিকান স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা বৃত্তি এবং এককালীন দান হিসেবে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে । এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গবেষণা কর্মে, বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে নতুন আবিষ্কার ইত্যাদি কাজে প্রচুর আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে ।